পিতা মাতা। হতভাগ্য এই যুবকের বাবা-মার দেওয়া নাম ছিল ইমাম মিয়া। অভাবের তারনার তাকে হল্যান্ডের এক প্রবাসী দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন জন্মদাতা পিতা। এরপর ইমাম মিয়া বেড়ে ওঠেন ক্রিম ইমাম হুরমান নামে।
অনুষন্ধানে ক্রিস শুধু বাবার নাম জানতে পারেন ‘নাসের মিয়া’। পেষায় তিনি ছিলেন নৌকার মাঝি। থাকতেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর
এলাকায়। এর বাইরে বাবা সহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের খোঁজে পেতে তেমন কোন
তথ্য ক্রিসের হাতে নেই। তবুও সমান্য উৎস নিয়েই বাবা-মার খোঁজে
হতভাগ্য যুবক ক্রিস এখন বাংলাদেশে। স্বজনদের খোঁজে পেতে
চষে বেড়াচ্ছেন রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত। প্রশ্ন হলো শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারবেন তো ক্রিস।
সম্প্রতি এক বান্ধবীকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ক্রিস ইমাম। ওঠেছেন গুলশানে এক প্রবাসী বন্ধুর বাসায়। বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের খোঁজে পেতে তিনি ঢাকার বিভিন্ন পরিচিত লোকদের সহযোগিতা
নিয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে মিডিয়ার সহযোগিতা নেওয়ারও চেষ্টা করছেন
তিনি। তাঁর কথা একটাই প্রকৃত বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের পেতে চান
তিনি। সন্তানের দাবি নিয়ে হাজির হতে চান বাবা-মায়ের সামনে। চমক দিতে চান সবাইকে। প্রতিষ্ঠা করতে চান নিজের পিতৃ পরিচয়।
প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময়ের অনুষন্ধানে ক্রিস জানতে পেরেছেন তাঁর বাবা এখনও বেঁচে
আছেন। তবে কোথায় আছেন তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তাকে সহায়তা যারা করছেন তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছে ক্রিসের বাবার সন্ধান পাওয়া
গেছে। গেল রমজানেও তাকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় দেখা গেছে। কেউ বলছেন নাসের মিয়ার বাড়ি ফরিদপুরে। কেউ বলছেন অন্য কোথাও।
বাবা ইউলিয়ামের কাছ থেকে ইমাম মিয়া জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের কোন এক খুপরি ঘরে তাঁর জন্ম। জন্মের মাত্র চার সপ্তাহের মাথায় বাবা নাসের মিয়া অভাবের তারণায় তাকে বিক্রি করে
দিয়েছিলেন হল্যান্ডের এক প্রবাসী দম্পতির কাছে। তখন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশে
জন্ম নেয়া ইমাম মিয়া হয়ে গেলেন ক্রিস ইমাম হুরমান। ১৯৭৭ সালের ১০ মে ইমামের জন্ম। বাবা নাসের মিয়ার সড়ক
দুর্ঘটনায় এক পা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর পরও এক পায়ে ভর
দিয়ে কিছুদিন রাজধানীর বসিলা, হাজারীবাগ, মনেশ্বররোড, মোহাম্মদপুর সহ আশাপাশের এলাকায় গুদারাঘাটে নৌকায় মানুষ পারাপার করতেন। তবে ক্রিস ইমামের পাসপোর্টে তাঁর শিশুকালের ঠিকানা হিসেবে মনেশ্বররোড-মোহাম্মদপুর
উল্ল্যেখ রয়েছে। অভাবে পড়ে বাবা তাকে বিক্রি করে দিয়েছেন? তাতে কি। একথা জানার পরও ক্রিস
একটুও বিচলিত নন। পরিবারের প্রতি কোন অভিমান বা রাগ নেই তাঁর। পুরো বিষয়টিকে সহজভাবেই মেনে নিয়েছেন তিনি।
ক্রিস ইমাম জানিয়েছেন, সম্প্রতি পালিত বাবা-মা
জানিয়েছেন তাঁর প্রকৃত বাবা-মা বাংলাদেশী। তবে পালিত বাবা-মা
চান ক্রিস তাঁর পরিবারকে খোঁজে পাক। ক্রিসকে বাবা উইলিয়াম
জানান, নাসের মাঝি যখন দুর্ঘটনার পা হাড়ানোর পর সংসারে নেমে আসে ঘোর
অন্ধকার। এক পর্যায়ে নৌকা চালানোও তাঁর বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাত পরিবারের চাকা আর চলে না। একবেলা খেলে আরেকবার
খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ক্রিস ছাড়াও নাসের মাঝির ছিল আরো দুই সন্তান। তাই আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছিল ইমামের। স্থানীয় বেবী হোমের
মাধ্যমে হুরমান দম্পতি খোঁজ পান নাসের মাঝির পরিবারের।
অল্প টাকার বিনিময়ে ইমাম মিয়াকে হল্যান্ডের এই দম্পতির কাছে বিক্রি করতে রাজী হন
নাসের মাঝি। তখন ইমামের বয়স ছিল দেড় মাস। ক্রিস ইমাম তাঁর প্রকৃত বাবা সম্পর্কে এও জানতে পারেন, নাসের মাঝির বাড়ি ছিল ঢাকার বাইরের কোন এক জেলায়। অভাবের তাড়নায় পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। থাকতেন মোহাম্মদপুরের মনেশ্বর রোডের কোন এক বাড়িতে।
এদিকে ইমাম মিয়াকে কেনার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরী শেষে তাকে নিয়ে হল্যান্ডে
চলে যান বাবা ইউলিয়াম হুরমান ও মা ক্যাটরিনা হুরমান। হল্যান্ডের জুটেমিয়ার শহরে পালিত বাবা-মার কাছে ইমাম মিয়ার বেড়ে ওঠা। ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী মাঝির ছেলে ক্রিস। অর্থনীতিতে পিএইচডি শেষে লন্ডনের একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে
তিনি কর্মরত। কিন্তু ইমামের মনে এখন একটাই চেষ্টা বাবা-মা সহ তাঁর পরিবারকে
ফিরে পাওয়া। তাই বন্ধু অনিতাকে নিয়ে ক্রিস এখন রাজধানী ঢাকায়।
ইমাম মিয়া বলেন, বাংলাদেশে আমার জন্ম। তাই মনে প্রাণে আমি একজন বাঙালি। দেশে এসেছি সত্যিকারের
বাবা-মায়ের খোঁজে। পরিবারের সদস্যদের খোঁজে পেতে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন। ইতোমধ্যে ঢাকার বেশ কয়েকজন বন্ধু তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের নিয়ে সম্ভাব্য জায়গায় পরিবারের সন্ধ্যানে এখন ক্রিস।
বাংলাদেশে ক্রিসকে সহয়তাকারী আহমেদ হোসেন বাবু জানান, ক্রিস দেশে আসার পর সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে অনুষন্ধান চালিয়েছেন
তারা। এর মধ্যে রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় দুই দিন খোঁজ করেন ক্রিসের
পরিবারের। স্থানীয়দের অনেকেই ক্রিসের বাবা নাসের মাঝিকে চিনতে পেরেছেন। তারা জানিয়েছেন, গেল রমজানেও লাঠিতে
ভর দিয়ে এই এলাকায় চলতে দেখেছেন তাকে। এরপর থেকে নাসের মাঝির
খোঁজ নেই। তিনি বেঁচে আসেন নাকি মারা গেছেন তাও জানেন না কেউ। এলাকায় ক্রিসের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ মেলেনি। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেছেন, নাসেরের গ্রামের বাড়ি
ফরিদপুর। কেউ বলছেন নোয়াখালী।
বাবু জানান,
বাবা-মা সহ পরিবারের খোঁজ পেতে কান্নাকাটি
করছেন ক্রিস। কিন্তু বেশিদিন ছুটি না থাকায় হয়ত দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে ফিরতে
হবে। এবার পরিবারকে খোঁজে না পেলে আবারো বাংলাদেশে আসবেন ক্রিস ইমাম।